সনজয় কুমার রায়: আমার মেঝো ভাই চট্টগ্রামে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করে।পদের আকার যাই হোক, ছুটির আকার একেবারেই ছোট – তিলের মত।পোশাক কারখানা বলে কথা।পোশাক কারখানা সম্পর্কে অনেকেরই ধারনা হলো ওখানে কম শিক্ষিত লোকেরা কাজ করে, নিম্ন বিত্ত কিংবা বিত্তহীনরা কাজ করে ওখানে।খুবই কম বেতনের চাকরি।তৈরি পোশাক খাত হল বাংলাদেশের বৈদেশিক মু্দ্রা অর্জনের প্রধানতম মাধ্যম।বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের একচেটিয়া ক্রেতা হলো বিদেশীরা।এদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চলের অধিকাংশ কারখানার মালিকও আবার বিদেশী।তাদের বড় বড় কর্মকর্তারাও বিদেশীদের খয়ের খা।জি হুজুর, জি হুজুর ভাব।এদেশের খেটে খাওয়া প্রান্তিক অবহেলিত শ্রমিক শেণির জন্য তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই।তাদের সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে খুবই উদাসিন কর্তৃপক্ষ।এই শ্রমিক শ্রেণির মানুষদের জন্যই তাদের এত এত উপার্জন।যদিও তারা এ শ্রেণির লোকদের মলিকপক্ষ নেহাতই মানুষ মনে করে।মনে করে নিছক শ্রমিক হিসেবে, তাদের তৃপ্তির ঢেকুর তোলার উপাদেয় মাত্র।এই শ্রেনির মানুষেরা তাদের নির্ধারিত আট ঘন্টা কর্মদিবসের পাশাপাশি অতিরিক্ত কাজ করে যা তাদের ভাষায় ওভার টাইম।তাদের জীবনে বিনোদনের কোনো উপায় নেই।কেউ কেউ সহকর্মীদের সাথে এখানেসেখানে যায়।আমার ভাইয়ের অবশ্য এ অবস্থাও নেই।সে বিবাহিত এবং তার স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র থাকে গ্রামের বাড়িতে।তারা পথ চেয়ে থাকে কবে বাড়ি আসবে প্রিয় বাবা অথবা প্রিয়তম স্বামী।ওদিকে অস্থির চিত্তে সময় অতিবাহিত হয় কবে হবে ছুটি, কবে ছুটে যাবো প্রিয় মুখগুলো দেখতে।এভাবে স্বপ্নের সাগরে ভাসতে ভাসতে সময় ছুটে চলে আপন গতিতে।দীর্ঘ ছুটির একমাত্র উপায় হলো ঈদের ছুটি।যদিও তা সর্বোচ্চ দশ দিন।এর বেশি নয়।তবে এটাও তাদের কাছে মনে হয় কয়েক মাস!এতেই তারা মহাখুশি।ছুটি পায় হয়তোবা ঈদের দুই-এক দিন আগে।ধর্ম-বর্ন নির্বিশেষে এই ছুটিটাই উপভোগ্য সকল চাকরিজীবীর কাছে।আমার মেঝো ভাই আমাকে খুবই ভালোবাসে।ভালো-মন্দ সবকিছু শেয়ার করে।আমার সাথে প্রায়ই ফোনে কথা হয়।ভালো-মন্দ আলাপ আলোচনা করে।বউ, ছেলে এবং বাড়ির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়।
ঈদ কাছাকাছি এসেগেছে।তাই ওকে ফোন করলাম।
“হ্যালো, কেমন আছিস?” ফোনটা তুলতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“এইতো, মোটামুটি আছি।তুই কেমন আছিস?” ব্যস্ততার সাথে বললো ও আমাকে।
“সাবাই ভালো আছি।তুই কি খুব ব্যস্ত?” আমার প্রশ্ন।
“না, তেমন না।ভাত রান্না হয়ে গেছে।চুলায় তরকারি।” তাড়াতাড়ি করে বললো ও।
আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা যে ও ব্যস্ত নাকি আয়েশ করছে।
আমার ভাই একটা মেসে থাকে।একটা রুমে চারজন একসাথে থাকে।ভাড়া সমানভাগে দেয়।বিদ্যুত বিলও সমানভাগে দেয় কিন্তু সবার হাড়ি আলাদা।সবাই নিজেদের খাবার নিজেরা রান্না করে খায়।যদি কোনো ভালো-মন্দ খাওয়া-দাওয়া হয় তখনকার ব্যাপার আলাদা।
“আচ্ছা, ঠিক আছে।রান্না শেষ কর।পরে না হয় কথা বলবো।” আমি একটু সমবেদনার সাথে বললাম।
“না, সমস্যা নেই।কি বলবি, বল।” ও নাছরবান্দার মত বললো।
“বাড়ি আসবি কবে?” আমি ওকে জিজ্ঞেস করি।
“ছুটি হলেই আসবো।আসার আগে তোকে জানাবো।রাখি।” বলেই ও ফোনটা রেখে দিলো।
ঈদ একেবারেই সন্নিকটে।সবার ভিতর একটা অন্যরকম অনুভুতি।উৎসব উৎসব আমেজ।
ঈদের দুই দিন আগে হঠাৎ আমার ভাইয়ের ফোন এলো।
“আগামীকাল ছুটির পরই সন্ধ্যায় রওনা হবো।” আমাকে একটু উৎফুল্ল হয়েই বললো।
আমিও উচ্চকিত হয়ে বললাম, “তাহলেতো পরশু সকালেই বাড়ি এস পৌঁছাবি।”
“যদি কোনো সমস্যা না হয় তাহলেতো সকাল সকালই পৌঁছে যাবো।” ও বললো।
আমি আনন্দে উদবেলিত হয়ে বললাম, “সাবধানে আসিস।গাড়িতে উঠেই ফোন করবি।সবাই তোর অপেক্ষায় রইলাম।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।এখন রাখ।” ও ফোন রেখে দিলো।
ছুটি পাওয়ার সাথে সাথেই রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।ব্যাগ-ট্যাগ আগেই গোছানো ছিলো।ছেলের জন্য, বউয়ের জন্য, অন্যান্যদের জন্য সাধ্যমত কেনাকাটা আগেই সেড়ে রেখেছিলো।ঈদের সময়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে গ্রামে বিশেষ করে বরিশাল, ঝালকাঠী আসা খুব সহজ নয়-ভীষন কঠিন।গাড়িতে সিট পাওয়া যায়না, পাওয়া গেলেও মূল্য অনেক বেশি।
আমার ভাই ট্রেনে করে কোনমতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে যাত্রীর চাপে চ্যাপ্টা হয়ে চাঁদপুর এলো।তারপর লঞ্চ।লঞ্চের অবস্থা আরও খারাপ।যখন রওনা হয়েছে, যে করেই হোক বাড়িতো পৌঁছতেই হবে।একটা লঞ্চে ওঠে।সারাটা রাত দাড়িয়ে থাকতে হবে, বসারও কোনো উপায় নেই।
আমি সন্ধ্যা পর থেকে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেই যাচ্ছি।লাইন পাচ্ছিনা।সারারাত খুব উৎকন্ঠায় কাটিয়েছি সবাই।সকালবেলা আমার ভাই এসে বাড়ি পৌঁছালো।আমরা দৌড়ে বাইরে গেলাম।
“আমার ফোনটা কোন সময় যেনো চুরি হয়ে গেছে!” বললো ও।